
 
টাঙ্গাইলে ব্যাপকহারে বেড়েছে পল্লীবিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের কোন কৌশলই যেন কাজে লাগছে না। সংঘবদ্ধ চোরের দল গভীর রাতে সেচ প্রকল্প এলাকা থেকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে ট্রান্সফরমার। এছাড়াও প্রতিদিনই কোনো না কোনো সেচপাম্প এলাকা থেকে স্থাপিত ট্রান্সফরমারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে  যাচ্ছে। এতে সেচপাম্প এলাকার কৃষকদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় কৃষকরা চুরি রোধে রাত জেগে অনেক এলাকায় রাতে  ট্রান্সফরমার পাহারা দিচ্ছেন । কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, বিদ্যুত বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন ছাড়া এতবড় ট্রান্সফরমার চুরি করা কখনই সম্ভব না। বিভিন্ন এলাকার সংঘবদ্ধ চোরের দল তাদের সাথে সখ্যতা তৈরী করে ট্রান্সফরমার ও যন্ত্রাংশ চুরি করে তাদের কাছে বিক্রি করে। 
টাঙ্গাইল পল্লীবিদ্যুত সমিতি সুত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ৩০টি, এলেঙ্গা জোনে ৮৭ টি, বাসাইল উপজেলায় ১৬টি, মির্জাপুর ও সখিপুর উপজেলায় ২৫টি, গোড়াই জোনাল এলাকায় ১৩টি, দেলদুয়ার উপজেলায় ২৭টি, নাগরপুর উপজেলায় ২২টি। মোট ২৩০টি ট্রান্সফরমার গত এক বছরে চুরি হয়েছে।  এর মধ্যে ৫ কেভিএ ১১৩টি, ১০ কেভিএ ৭৩টি, ১৫ কেভিএ ৯টি, ২৫ কেভিএ ২৭টি, ৩৭ দশমিক ৫ কেভিএ ৪টি, ৫০ কেভিএ ৪টি। যার মুল্যে প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়াও  ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ জোনে গত এক বছরে মধুপুর,  ধনবাড়ী, গোপালপুর, ঘাটাইল ও ভূঞাপুরে প্রায় দেড় শতাধিক  ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলা চলে ন্যাশনাল গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়ে। বিদ্যুৎ চালিত সেচে সবচেয়ে দামি যন্ত্রাংশ হলো ট্রান্সফরমার। এর ভেতরে থাকে পিতলের দামি কয়েল। এ তারগুলোর ভেতরের অংশ তামার (পিভিসি ক্যাবল) উপরের কাভার পুড়িয়ে ফেলে তামাগুলো বিক্রি করে চোর চক্র। এসব কয়েলের লোভে সংঘবদ্ধ চোরের দল চুরি করে ট্রান্সফরমার। অনেক স্থানে রাতের বেলা সেচ স্কিমের পাহারাদারকে বেঁধে রেখে ট্রান্সফরমার চুরি করে। বিদ্যুতের কাজের উপর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সম্পন্ন না হলে এত দ্রুত খুটির উপর থেকে ট্রান্সফরমার নামানো সম্ভব না। এছাড়াও রয়েছে বিদ্যুতের শকের চরম ঝুঁকি।  
নাগরপুরের গয়হাটা উদয়তারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। তিনি তিনশ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন। গত ৩ আগষ্ট আগত গয়হাটা সেচ প্রকল্প থেকে তার ট্রান্সফরমারটি চুরি হয়ে যায়। তিনি বলেন, এই চোর চক্রের সাথে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন জড়িত রয়েছে। সংযোগ থাকা ট্রান্সফরমার কিভাবে এত দ্রুত খুলে ফেলে। এছাড়াও খুটি  থেকে নামিয়ে আনা অভিজ্ঞ লোক ছাড়া কখনো সম্ভব না। বিদ্যুৎবিভাগের লোকজনের এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া খুবই প্রয়োজন । না হলে এই চুরি কখনো বন্ধ হবে না।  বিনা মুল্যে ট্রান্সফরমার পেয়েছিলাম। এখর প্রায় ৫২ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হবে। ধান চাষ করে যে আয় হবে তার সব টাকাই ট্রান্সফরমার ক্রয় করতে খরচ হয়ে যাবে। ব্যপক ক্ষতির সম্মুখিন হলাম।
একই এলাকার বিপ্লব হোসেনের ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে ৩ আগষ্ট।   তার ভাষ্য, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ট্রান্সফরমারসহ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। ট্রান্সফরমার চুরি হলে সেক্ষেত্রে ট্রান্সফরমারের সম্পূর্ণ মূল্য তাদের পরিশোধ করতে হয়। মূল্য পরিশোধ না করা পর্যন্ত সেখানে ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপন করা হয় না। ফলে ট্রান্সফমরার চুরি ঠেকাতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সখিপুরের কচুয়া ফিডারের আড়াইপাড়া এলাকার বিল্লাল হোসেন ও শামসুল হক, একই ফিডারের রফিকুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল কাদেরের ট্রান্সফরমারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি হয়। সম্পুর্ন মুল্যে দিয়ে তাদের নতুন করে ট্রান্সফরমার নিতে হবে।তবে আর্থিক অনটনে তাদের এবার বোরোচাষ হুমকির মুখে পড়েছে। 
২০০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন দেলদুয়ারের  আনোয়ার হোসেন। তার ভাষ্য, টানা ২০ বছর ধরে বিদ্যুৎ  চালিত একটি সেচ মোটর চালান। আগে ট্রান্সফরমার চুরি গেলে অর্ধেক দামে সরবরাহ পেতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি  এ সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার সেচ খাতে ভর্তুকি দেয় শুনেছি। তাহলে ট্রান্সফরমার চুরির ক্ষেত্রে গ্রাহকরা কেন ভর্তুকি মূল্যের সেই সুযোগ পাচ্ছেন না?
এদিকে গত ১৩ আগষ্ট নাগরপুর থেকে  ভারড়া ইউনিয়নের চান্দক গ্রামের রবিউল ইসলাম এর ছেলে মনিরুল ইসলাম ও চান মিয়ার ছেলে সিদ্দিক হোসেনকে তামা ৩৩ কেজি, ষ্টিলপ্লেট ৯৭ কেজি, তামার তার ২৬ কেজি ট্রান্সফরমারের সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করে। যার মুল্যে প্রায় ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৭ শত টাকা। এর আগে কালিহাতীর জোকারচর কদিম হামজানী থেকে ট্রানফরমার চুরি করার সময় দুই চোরকে হাতে নাতে আটক করে পুলিশে দেন এলাকার মানুষ। পরে টাঙ্গাইল পল্লীবিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মোঃ ছানোয়ার হোসেন বাদি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। 
টাঙ্গাইল পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি পরিচালনা বোর্ডের সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায়ই  ট্রান্সফরমার চুরির খবর আসে।  ট্রান্সফরমার চুরি হলে গ্রাহকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ও ভোগান্তির শিকার হন। চুরি হলে মামলা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। কয়েকদিন পর বের হয়ে আবার চুরি করে।এখানে সমিতির কর্মকর্তাদের  নজরদারি ও কৃষকদের সচেতন হতে হবে।  এছাড়াও চুরি ঠেকাতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের দাবি করেন তিনি। কারণ চোরদের সাথে এলাকার টেকনোশিয়ানরা জড়িত। সিসি ক্যামেরা থাকলে সহজেই তাদের সনাক্ত করা যাবে। 
 টাঙ্গাইল পল্লীবিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মোঃ ছানোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিমাসেই ট্রান্সফরমার চুরি হচ্ছে। চুরি রোধকল্পে পুলিশ প্রশাসনসহ জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামাজিক ব্যক্তিসহ সকলকে নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সভা সমাবেশ মোটিভেশন মিটিং গনশুনানী উঠান বৈঠক লিফলেট বিতরণসহ সকল প্রকার কার্যক্রম চালয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও সেচ প্রকল্প এলাকায় মাইকিং করে কৃষকদের সতর্ক করা হচ্ছে। তারা যেন ট্রান্সফরমার খুটির সাথে তালা লাগিয়ে অথবা খাঁচা লাগানোর ব্যবস্থা করেন। এছাড়া মৌসুম শেষ হয়ে গেলে যেন কৃষকরা ট্রান্সফরমার খুলে বাড়িতে নিয়ে রাখেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অবস) আদিবুর রহমান বলেন, ট্রান্সফরমার চুরি ঠেকাতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। যেসব থানা এলাকায় ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুৎ সরঞ্জামাদী চুরি হচ্ছে সেইসব থানায় মামলা হচ্ছে। পুলিশ  মালামাল উদ্ধার করছে। চুরির সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে। তবে একবছরে এত ট্রান্সফরমার চুরি হলেও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি থেকে আমাদেরকে কিছুই জানানো হয়নি।